ওভারডোজ
কল্যাণী রমা
এখনো পাহাড়ের ক্লিফে, ঈগল পাখির বাসা থেকে ঈগল পাখির বাচ্চার মত চিঁ চিঁ শব্দ শোনা যাচ্ছে।তবু বহুদূরে পাহাড়ের নিচ থেকে ভেসে আসছে ঘন্টার শব্দ, ধূপের গন্ধ। পায়ের কাছেই নূপুরের মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে জীবনের উৎসব। আছে জল, মাটি, সবুজ মাঠ। সবুজ মাঠটা এতটাই দূরে যে মনে হচ্ছে যেন একটা বিন্দু। সবুজ কিংবা গাঢ় বাদামি বিন্দুটা তবু প্রতিদিন একটু একটু করে বড় হচ্ছে। একদিন তা একটা দিগন্ত-বিস্তৃত সবুজের সমুদ্র হয়ে যাবে। তার উপর থোকা থোকা হলুদ রঙের বুনো ফুলের মত, ভালোবাসার মত প্রজাপতিরা উড়ে যাবে।
ঈগল পাখিরা আকাশে উড়তে পারে। ঝড়ের মেঘের উপর দিয়ে।
(১)
জীবনে বিতৃষ্ণা নেই আনন্দর । তবে তৃষ্ণা শেষ হয়ে গেছে।গত ছয়মাস থেকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার নানা উপায় খুঁজে চলেছে ও। আসলে আনন্দর আছে বাই পোলার ডিসঅর্ডার ওয়ান। কিছুদিন ম্যানিয়া হয়। ঘুমাতে পারে না দিনের পর দিন। একবার বাইশ দিন ঘুমাই নি ও। এবার টানা বারো দিন । খুবই এংসাইটি আর অস্থিরতা বেড়ে গেছে। আর তার পরই আসে ডিপ্রেশন। বেড়ে যায় মৃত্যুর চিন্তা, দুর্বিসহ মন খারাপ। কিছুই রান্না করে না আনন্দ। তিনমাস শুধু দুধ সিরিয়াল খেয়ে আছে। ও শুনেছিল এপস্টেইনের প্রাসাদে মেয়েদের নাকি শুধু দুধ সিরিয়াল খেতে দিত। খেতে গিয়ে সময় নষ্ট করবার সময় নেই। আনন্দও সেই পথ ধরল।
কীভাবে পৃথিবীর আলো, হাসি, গান ফেলে চলে যাওয়া যায় সে চিন্তায় মগ্ন হয়ে উঠ্ল।
প্রথমে মনে হ’ল পিস্তল দিয়েই কাজটি সারবে ও। আমেরিকার সংবিধানের সেকেন্ড এমেন্ডমেন্টের জন্য যে কেউ নিজের কাছে বন্দুক রাখতে পারে। আনন্দও নেশাগ্রস্তের মত পিস্তল যোগাড় করবার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল।
তারপর মনে হ’ল রান্নাঘরের কাঠের সুন্দর হাতলওয়ালা ছুরি দিয়েই কাজটি সারবে ও। মৃত্যু যদি হবেই, সুন্দরের হাতেই হোক। আনন্দর কুকুর ক্রোকাস সারাদিন পায়ে পায়ে ঘোরে। মাঝে মাঝেই আনন্দর সাথে ও একা একা থাকে। মনে হ’ল ছুরি দিয়েই যদি কিছু করে, আনন্দর রক্তের ভিতর বসে ক্রোকাস কুঁই কুঁই করে কাঁদবে। ও তো কষ্ট পাওয়া ছাড়া আর কিছু করতে পারবে না। ক্রোকাসকে কষ্ট দিতে পারল না আনন্দ।
কিন্তু আনন্দকে যে যেতে হবে। শনিবারের সকাল। ৩০শে সেপ্টেম্বর। আনন্দের আগের ওষুধ ছিল। তা ছাড়া ফার্মেসী থেকে ফুল প্রেসক্রিপশনও ভরে আনল ও। আনন্দের এক্স-হাসবেন্ড সূর্য-র বাড়িতে গিয়ে মিষ্টি কুকুরছানা ক্রোকাস, আনন্দর বড় মেয়ে এলা, আর সূর্যের সাথে দেখা করে এল আনন্দ। ক্রোকাসের সাথে কিছুক্ষণ বল নিয়ে খেলল। কয়েকজন প্রিয় বন্ধুকে ফোন করল। শেষবারের মত ওদের সাথে হাসল।
বাড়িঘর গুছাল। আনন্দর মৃত্যুর পর কেউ যেন ওর ঘরদোর নিয়ে সমালোচনা না করে।
ভারী সুন্দর একটা নীল রঙের কাঁচের গ্লাস আছে আনন্দর। তার গায়ে সমুদ্রের ঢেউ-এর মত আঁকা। সেই গ্লাসে জল ভরল ও। তারপর মুঠো মুঠো ওষুধ খেতে শুরু করল। ওভারডোজ। হালকা গোলাপি, হালকা নীল, হালকা হলুদ আর সাদা রঙের ওষুধ…বেবি কালার সব…হাতছানি দিয়ে ডাকছে নরম রঙের hydroxyzine, lithium carbonate, clonazepam, oxcarbazepine, propranolol, risperidone, ambien…সিলভিয়া প্লাথের “Paralytic” কবিতার কথা মনে পড়ল। দাঁতের উপর সারি সারি ওষুধ, মুখভর্তি ওষুধ। মুক্তার মত ঝলমল করছে। মৃত্যুর পথে চলেছে প্লাথ। আনন্দও।
সূর্যকে ফোন করেছিল আনন্দ। তারপর আর কিছু মনে নেই ওর। সূর্য এসে 911 কল করে। “Shurjo saved my life.” ততক্ষণে অজ্ঞান হয়ে গেছে আনন্দ। পুলিশের গাড়ী, ফায়ার ট্রাক আর এম্বুলেন্স আসে। মুখ দিয়ে ফেনার মত ওষুধ বের হচ্ছে ততক্ষণে। একা ছিল বাড়িতে আনন্দ। অজ্ঞান হওয়ার আগে যদি ফোনটা না করতে পারত, বাঁচানো যেত না ওকে। প্যারামেডিক বলেছিল হাতে মিনিট দশেক সময় আছে। ধীরে ধীরে কমে আসছে হার্টবীট। নিভে আসছে জীবনের প্রদীপ। এম্বুলেন্সের আলো জ্বালিয়ে ওরা ছুটে যায় ইমারজেন্সির দিকে।
এরপরের সবকিছুই শোনা কথা। ব্রিদিং টিউব, টেম্পরারি পেসমেকার বসায় ওরা। কনসেন্ট দিয়েছিল আনন্দর বড় মেয়ে এলা। এলা দিতে না পারলে দিতে হ’ত আনন্দর ছোট মেয়ে খেলা-র। আর তা না হ’লে আনন্দর ছোটবোন অশ্রুর। ফিডিং টিউবের কনসেন্ট দিয়েছিল খেলা। ভেন্টিলিটারে পাঁচদিন রেখেছিল আনন্দকে। ও আই সি ইউ (intensive care unit)তে ছিল সাতদিন। তারপর দুইদিন জেনারেল ওয়ার্ডে, তারপর সাতদিন সাইক ওয়ার্ডে(psychiatric ward)।
মৃত্যু থেকে ফিরে এসেছে আনন্দ।
“I am Lazarus, come from the dead,
Come back to tell you all, I shall tell you all”
(The Love Song of J. Alfred Prufrock , T. S. Eliot)
(২)
আনন্দর মনে পড়ছিল কোলরিজের ‘কুবলা খান’ কবিতার কথা।
“In Xanadu did Kubla Khan
A stately pleasure-dome decree:
Where Alph, the sacred river, ran
Through caverns measureless to man
Down to a sunless sea.”
(Kubla Khan, SAMUEL TAYLOR COLERIDGE)
এ কবিতা এসেছিল কবির ‘vision in a dream’ হয়ে। কিন্তু আনন্দ হচ্ছে অরেঞ্জ পিকো চায়ে লেবু চিপে খাওয়া মানুষ। হ্যালুসিনেশনের কোন জায়গা নেই ওর জীবনে।
কিন্তু এবার হসপিটালে সেই হ্যালুসিনেশনই শুরু হ’ল ওভারডোজের জন্য। আনন্দর হাত পা বাঁধা বেডের সাথে যেন ও টিউবগুলো খুলে না ফেলে।
এত স্পষ্ট সব স্বপ্নের মত ছবি! আনন্দ দেখছে Lamborghini গাড়ি চেপে বিদ্যুৎ গতিতে ও ছুটে চলেছে ম্যাডিসন, উইস্কনসিন থেকে পোর্টল্যান্ড, ওরেগনের দিকে। ২,০০১ মাইলের পথ ওরা এক ঘন্টায় পার হ’ল। গাড়িতে সাথে আছে দু’জন নার্স, আর কিছু পেশেন্ট। আনন্দর ছোটবোন অশ্রুর বাড়িতে পার্টি হচ্ছে। সেখানেই যোগ দিতে যাচ্ছে ওরা। পার্টিতে মাছ গ্রিল করা হ’ল। বড়ই সুস্বাদু। এখনও জিভে লেগে আছে। অশ্রুর বসবার ঘরে বসে হাসি, গল্পে মেতে উঠল ওরা। তারপর ম্যাডিসনে ফিরে এসে আবার একবার Lamborghini-তে চেপে পোর্টল্যান্ড গেল আনন্দ। রাতটা কাটল এইটিন হুইলার ট্রাকে। হসপিটালে বেড খালি নেই। আনন্দর সাথে আরো কিছু পেশেন্ট।
তারপর আস্তে আস্তে একটা ঘরের দরজা খোলে আনন্দ। দেখে একজন অল্পবয়েসী মেল নার্স ভিডিও গেম খেলছে। ডার্ট ছুঁড়ে ছুঁড়ে এই খেলা। কিন্তু নার্সটি খেলছে ডিউটির সময়। আনন্দ দেখে ফেলেছে বলে ওকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চাইল নার্স। নার্স আনন্দকে বলল, ‘এস, তোমাকে একটা ইঞ্জেকশন দেই, ভালো লাগবে তোমার।’ আসলে তাও ছিল আনন্দকে মেরে ফেলবার চেষ্টা। আনন্দর বড় মেয়ে এলা অনেক ভিডিও গেম খেলে। এলাকে ফ্রেম করতে গেল নার্স। যেন এলাই খেলেছে ডার্টগেম। নার্স নয়। এলাই মা’কে মেরে ফেলবার চেষ্টা করছে। মৃত্যুর মুখেও সন্তানকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করে যে কোন মা। আনন্দও প্রাণপণ চেষ্টা করল এলাকে বাঁচাতে। হাত, পা বাঁধা, তবু কোনমতে লিখতে চাইল, ‘এলা ডার্টগেম খেলে না।’ শুধু লিখতে পারল গায়ের কমফোর্টারের উপর, ‘এ’।
এক সমুদ্র সৈকত। হলুদ আর কমলা ফুল আঁকা নরম কমফোর্টারের উপর শুয়ে আছে আনন্দ। বড় বড় জবাফুল আঁকা হলুদ রঙের হাওয়াইয়ান শার্ট পরে এক ডেন্টিস্ট। সাঁড়াশি দিয়ে আনন্দের মুখের ভিতর দাঁত দেখছে সে। আর আনন্দ বলে চলেছে,‘আমার দাঁতের সোনার ফিলিং নষ্ট কর না।’
একটু পর দেখে সূর্যর ছোটবোন এসেছে এ সময়ে দাদাভাই-এর পাশে থাকবার জন্য। আর বোনের পাশে থাকবার জন্য এসেছে বোনের বন্ধু। তন্দ্রার মধ্যে আনন্দ শুনতে পায় বোন বলছে বন্ধুকে, ‘বাবা মা-ও খুব চিন্তা করছে আনন্দর জন্য। ওরা প্রদীপ জ্বেলেছে।’ স্বপ্নের ভিতর ভালোবাসার প্রদীপ ভেসে যায় সমুদ্রের জলে। আর সে আলোর ছায়া পড়ে আনন্দের চোখের পাতায়।
চোখ বন্ধ করলে একের পর এক সুখের ছবি দেখতে পায় আনন্দ। কিন্তু চোখ খুললেই দেখে আইসিইউ-র ঘর। আর সে ঘরের ছাদ থকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলছে মানুষ। ভয়ে তাড়াতাড়ি চোখ বন্ধ করে আনন্দ। আর দেখতে থাকে স্বর্গের ছবি।বিড়বিড় করে বলে-
‘I would build that dome in air,
That sunny dome! those caves of ice!
And all who heard should see them there,
And all should cry, Beware! Beware!
His flashing eyes, his floating hair!
Weave a circle round him thrice,
And close your eyes with holy dread
For he on honey-dew hath fed,
And drunk the milk of Paradise.’
(Kubla Khan, SAMUEL TAYLOR COLERIDGE)
(৩)
এক ফোঁটা জল। দিনের পর দিন এক ফোঁটা জলও খেতে দেয় না আনন্দকে নার্স। ব্রিদিং টিউবের জন্য জল খাওয়া নিষেধ। মাঝে মাঝে নার্স এসে এক টুকরো স্পঞ্জ জলে ভিজিয়ে তারপর তা চিপে সেই ভেজা ভেজা স্পঞ্জটা দিয়ে আনন্দের ঠোঁট মুছে দেয়। আনন্দের মনে হয় পৃথিবীতে এক ফোঁটা জল ছাড়া আর কোন চাওয়া নেই। তৃষ্ণায় চাতক পাখির মত আকাশের দিকে চেয়ে থাকে ও। তবে এ তো আকাশ নয়, এ হসপিটালের উজ্জ্বল আলোয় স্নান করা সাদা রঙের সিলিং।
কথাও বলতে পারে না আনন্দ ব্রিদিং টিউবের জন্য। একটা কাগজে লিখে লিখে মনের কিছু কথা জানায়।
প্রতিদিন হসপিটালে আনন্দকে দেখতে আসে আনন্দের এক্স-হাসবেন্ড সূর্য আর বড় মেয়ে এলা। এলা বলে,‘Mom, you are looking like a sci-fi movie. With all the tubes around…’
সূর্যর মুখে একটা অদ্ভুত দ্যুতি দেখতে পায় আনন্দ। মানুষ বাঁচালে, কোন প্রাণী বাঁচালে, কোন গাছ বাঁচালে এই দ্যুতি দেখা যায় মানুষের মুখে। আনন্দ কিছুতেই ভুলতে পারে না যে আনন্দের প্রাণ বাঁচিয়েছে অন্য আর কেউ নয় - সূর্য! গত বছর ডিসেম্বরে ডিভোর্স হয়ে গেছে ওদের। আর এখন সেপ্টেম্বর মাস।
এক সময় ব্রিদিং টিউব খুলবার চেষ্টা করে ডাক্তার, নার্স। আনন্দ throws up. কিছুটা চলে যায় ওর লাংসে। নিউমোনিয়া হয়ে যায় আনন্দর। ব্রিদিং টিউব খুলতে পারে না ওরা।
আনন্দ ভাবে হয়ত একসময় বন্ধ করে দেবে এই ব্রিদিং টিউবের শ্বাস, প্রশ্বাস। আর তারপর মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়বে আনন্দ।
না, তা হয় না। নিজে নিজে আবার নিশ্বাস নিতে পারে আনন্দ। শুধু গলা দিয়ে কোন স্বর বের হয় না। আনন্দ ভাবে তবে কি ওর গলার স্বর হারিয়ে গেল? বিকালের দিকে অল্প অল্প শোনা যায় ওর কথা। আবার আস্তে আস্তে কথা বলতে পারে আনন্দ সূর্য আর এলার সাথে।
(৪)
আনন্দ হাঁটতে ভুলে গেছে। এক পা, দু’ পা করে আবার ওকে হাঁটতে শেখাচ্ছে নার্স। দু’ পাশে দু’জন নার্স, পিছনে ফিজিক্যাল থেরাপির লোক, কোমরে গেট বেল্ট – হাঁটবার চেষ্টা আনন্দর। ‘হাঁটি হাঁটি পা পা, খুকুমণি হেঁটে যা।’ কিন্তু পাঁচ, ছয় পা গিয়েই বসে পড়ে চেয়ারে আনন্দ। আর হাঁটতে পারে না ও।
হাঁটতে না পারলে কী হবে! প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করা তো থেমে থাকবে না তা বলে। হাসপাতালের ছাদে আছে এক হিলিং গার্ডেন। দু’জন নার্স হুইল চেয়ারে করে আনন্দকে নিয়ে গেল সেই গার্ডেনে। পথে হাসপাতালের নানা করিডোর। একজন নার্স একটা করিডোরের নাম দিল ‘ডগ পাথ’। আসলেই তাই। গোল্ডেন রিট্রিভার, ল্যাব্রাডর রিট্রিভার, পুডল আর নানা কুকুরের পেইন্টিং ঝুলছে করিডোরের দেওয়ালে। নিজের বর্ডার কলি পাপ ক্রোকাসের কথা মনে হয়। ‘পাথ’টা পেরিয়ে আনন্দ এসে পৌঁছাল ছাদের হিলিং গার্ডেনে। অল্প একটু জায়গা, কিন্তু অপূর্ব সে বাগান। থোকা থোকা বেগুনি, গোলাপি, হলুদ রঙের জিনিয়া ফুটে আছে। ফুটে আছে বেগুনি রঙের ভেরোনিকা। অনেক বাম্বলবী বনবন করে ঘুরছে তার উপর। টুংটুং শব্দ করছে কপারের ঘন্টা। একটা দূরবীন মত যেন। তা দিয়ে দেখা যাচ্ছে নানা রকম ফুল বড় করে। একটা জাপানীজ ম্যাপল গাছ। লাল রঙ ধরতে শুরু করেছে তাতে। উইস্কনসিনে ‘ফল’ এসে গেছে – রঙের মাস। উইস্টেরিয়া পেঁচিয়ে উঠে গেছে পারগোলা বেয়ে। ছাদের উপর এমন অপূর্ব বাগান দেখে অভিভূত হয়ে যায় আনন্দ। হাঁটতে না পারার কষ্ট ভুলে যায় ও।
দেখে বাগানের ভিতর একটা লিটল ফ্রি লাইব্রেরী। কাঠের ছোট ঘর মত করে তাতে রাখা আছে বই। যার খুশি নিয়ে যাবে। আনন্দও নিল। Roald Dahl এর ‘Boy: Tales of Childhood’। মনে পড়ে গেল ছেলেবেলার কথা। মনে পড়ল বইতে কেমন লেখা ছিল –
“An autobiography is a book a person writes about his own life and it is usually full of all sorts of boring details.
This is not an autobiography. I would never write a history of myself.
” (Boy: Tales of Childhood, Roald Dahl)
(৫)
‘Boy: Tales of Childhood’ পড়তে শুরু করে আনন্দ। কত কত দিন পর পড়ছে আনন্দ। ছেলেবেলার বই। একটানে ১৮ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড়ে ওঠে। জ্বলজ্বল করছে বই-এর নিচে ১৮ সংখ্যাটা। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে আনন্দ বইটার দিকে। ১৮ সংখ্যাটার দিকে। আসলে আজকাল বাজারের ফর্দ ছাড়া আর কিছুই পড়তে পারে না আনন্দ। আর সাহিত্য বলতে হাইকু।
আঠারো বছর বয়স থেকেই বাই পোলার ডিসঅর্ডার আনন্দর। যদিও তা ধরা পড়ে বিয়াল্লিশ বছর বয়সে আমেরিকায়। এতগুলো বছর একা একা যুদ্ধ করেছে আনন্দ! ওর ফোকাস নষ্ট হয়ে গেছে। কোন বই পড়তে পারে না। খবরের কাগজ পড়তে পারে না। ম্যাগাজিন পড়তে পারে না। নাটক দেখতে পারে না। সিনেমা দেখতে পারে না। টিভি দেখতে পারে না। গান শুনতে পারে না। শূন্য খুলি নিয়ে ঘুরে বেড়ায় শুধু। অথচ কী পরিমাণ বই পড়ত ছেলেবেলায় আনন্দ! যতকিছু পড়া সব আঠারো বছর বয়সের আগে। ক্লিফ হ্যাংগারের মত আঁকড়ে ধরে থাকে আনন্দ যা কিছু পড়েছিল, ফিরে ফিরে লেখে তা নানা কোটেশনে। ওর চোখ বেয়ে জল পড়ে। বই পড়তে না পারার কষ্টটা বুঝি ওর নিজ মৃত্যুর কষ্টের থেকে বেশি। অথচ ও একদিন ভেবেছিল পৃথিবীর সব বই পড়ে ফেলবে। হিমালয়ের চূড়ায় যেমন আলো পড়ে তেমন আলোয় ওর জীবনও ভেসে যাবে। সাদা বরফের উপর সোনালি। ছেলেবেলার স্বপ্ন সফল হয় না। শুধু অন্ধকার রাতে ছেলেবেলার দিন ফিরে ফিরে আসে।
আনন্দ দেখে ও যেন বসে আছে দাদুভাই-এর ইঁট দিয়ে চারকোণা করে বানানো টবের পাশে। নানা রঙের পিটুনিয়া ফুটে আছে টবে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। খাওয়ার জন্য ডাকছে ওকে ডাইনিং টেবিলে। এদিকে খাওয়া নাওয়া ভুলে আনন্দ পড়ে চলেছে ওর সবচেয়ে প্রিয় বই। বার্টার্ন্ড রাসেলের অটোবাইওগ্রাফি। থান ইঁট একখান। সেই কবে পড়া। তবু আজও ভুলতে পারে না আনন্দ। বই-এর অক্ষরগুলো গাছের নিচে পড়ে থাকা কমলা রঙের বোঁটার শেফালি ফুলের মত জ্বলজ্বল করতে থাকে-
"Of Uncle William, I have a very painful recollection: He came to Pembroke Lodge one June evening at the end of a day of continual sunshine, every moment of which I had enjoyed. When it became time for me to say good-night, he gravely informed me that the human capacity for enjoyment decreases with the years and that I should never again enjoy a summer's day as much as the one that was now ending. I burst into floods of tears and continued to weep long after I was in bed. Subsequent experience has shown me that his remark was as untrue as it was cruel."
(৬)
আই সি ইউ-তে শাওয়ার স্টল নেই। শাওয়ার নেওয়ার মত অবস্থায় থাকে না রোগীরা সেখানে। আনন্দ-র নার্স আনন্দকে একটা চেয়ারে বসিয়ে গরম জলে তোয়ালে ভিজিয়ে গা স্পঞ্জ করে দিল। চুল আঁচড়ে দিল পরিপাটি করে। আনন্দ দেখে নার্সের বুকে ছয় সাত বছরের একটা বাচ্চা ছেলের ছবি সাঁটা। ওর ছেলে। সামনের দু’টো দাঁত পড়া। ফোকলা দাঁতে কী হাসি। কালো ফ্রেমের চশমা পড়া। খোঁচা খোঁচা চুল। আনন্দ বলল, ‘কী মিষ্টি ছেলে তোমার!’ গর্বিত মা বলল, ‘He is a good boy!’ আই সি ইউ-র গুরু-গম্ভীর মরা বাঁচা পরিবেশে এক ঝলক আলোর ঝিলিক বাচ্চাটা।
দু’ একদিনের মধ্যে আই সি ইউ থেকে ছেড়ে দেবে আনন্দকে। ক্রিটিক্যাল অবস্থা সামলে উঠেছে ও। কিন্তু এতদিনে আই সি ইউ-তে মন বসে গেছে আনন্দ-র। ছেড়ে যেতে মন সায় দিচ্ছে না আর। তা ছাড়া সবসময়ই তো ‘who moved my cheese’ অবস্থা ওর। নতুন কোন পরিবর্তন মেনে নিতে পারে না। কিন্তু এবার অন্যকে পথ ছেড়ে দিতে হবে।
আর খাবারও খেতে পারছে না আনন্দ। আই সি ইউ তে চারপাশে অসংখ্য ওষুধের গন্ধ। খাবারেও সে গন্ধ ঢুকে গেছে। ম্যান্ডারিন অরেঞ্জ আনন্দর খুব প্রিয়। লাঞ্চে অর্ডার করেছে। কিন্তু এক কোয়া মুখে নিয়েই আর খেতে পারল না। ‘হসপিটাল স্মেল।’
আনন্দর জিনিষপত্র গোছাতে শুরু করল নার্স। দুই দিনের জন্য জেনারেল ওয়ার্ডে থাকবে আনন্দ রেস্ট নিতে। তারপর সাইক ওয়ার্ড।
তবে জিনিষপত্র আর কি? অনেক খুঁজেও আনন্দর নিজস্ব জামা কাপড় খুঁজে পেল না নার্স। পরে বলল, ‘তোমাকে প্যারামেডিক্স জামা কাপড় কাঁচি দিয়ে কেটে তার ভিতর থেকে বের করেছে। সময় ছিল না ওদের হাতে।’ শুনে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে, মুচকি হেসে আনন্দ শুধু মনে মনে বলল, ‘রাজা, তোর কাপড় কোথা?’
(৭)
খুব ভোরবেলা আই সি ইউ থেকে জেনারেল ওয়ার্ডে আসল আনন্দ। সাথে ওয়াকার। এখনো ভালোভাবে হাঁটতে পারে না ও। কিন্তু কী অপূর্ব এই রুম। লেক মনোনার উপর। কোনদিন লেকের উপর থাকে নি আনন্দ। এ যেন আনন্দের পেন্টহাউস। হসপিটালের রুম বলেই মনে হচ্ছে না। জানালায় লতাপাতা আঁকা কাপড়ের পর্দা ঝুলছে। দেওয়ালে পেন্টিং। একটা বাড়ি। চারপাশে সাদা পিকেট ফেন্স। ফুলের বাগান। শান্তির ছবি। এদিকে জানালা দিয়ে তাকিয়ে আনন্দ দেখে লেকের উপর সূর্য উঠছে। সারা আকাশ লাল। তার মাঝে কমলা আর হলুদ রঙের ছোপ। জলরঙ যেন। তুলির টান। আনন্দ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখে জীবনের ছবি। নতুন দিনের শুরু। নতুন আলো।
কিন্তু আনন্দের পিছু পিছু এসেছে আই সি ইউ-র হসপিটাল স্মেল। সব খাবার, জামা কাপড়ে ওষুধের গন্ধ। মেল নার্স বেন বলল এসেন্সিয়াল ওয়েল ঘরে রাখলে হয়ত গন্ধ চলে যাবে। আসলেই তাই। ল্যাভেন্ডার এসেন্সিয়াল ওয়েল রাখল ঘরে নার্স।
ঘরের একটা দেওয়ালে বড় একটা আয়না। আই সি ইউতে আয়না ছিল না কোন। অনেকদিন পর আয়নায় মুখ দেখল আনন্দ। গলার কাছে না্না কাটা, ছেঁড়া, সেলাই-এর দাগ। মনে হ’ল জলোচ্ছ্বাসের কথা। ঝড় শেষে কেমন সমুদ্রতীরে ভাঙা গাছের ডাল পড়ে থাকে। পড়ে থাকে শ্যাওলা, ঝিনুক, শঙ্খ। লাল কাঁকড়ার খোলস।
(৮)
লেক মনোনার উপর ভেসে যাচ্ছে সেইলবোট। আকাশে উড়ছে সীগাল। সাদা সাদা মেঘ খরগোসের মত আকার নিয়েছে। তারপর বিড়াল আর তারপর ক্রোকাস কুকুরের মত। ক্রোকাসের কথা খুব মনে হয়। কতদিন দেখেনি ক্রোকাসকে আনন্দ। কী জানি ক্রোকাস কি ভাবছে এতদিন ওকে না দেখে। মানুষকে তো বোঝানো যায় কোথায় আছে, কেমন আছে আনন্দ। কুকুরকে বোঝাবে কিভাবে!
নার্স এসে পরীক্ষা করে দেখে আনন্দের মাথা ঠিকমত কাজ করছে কীনা। প্রশ্ন করে,’আমেরিকার এখনকার প্রেসিডেন্ট কে? আগের প্রেসিডেন্ট কে ছিলেন? কোন হসপিটালে আছে আনন্দ? আজকের তারিখ কত? কি বার? এক থেকে দশ উল্টো করে বলতে বলে।’ আনন্দ বলতে পারে মোটামুটি সব।
ডাক্তার এসে প্রশ্ন করে-‘Any thought of harming others? Any thought of hurting yourself? Hearing voices? Seeing things?’ ‘Any thought of harming others’ প্রশ্নে প্রবল মাথা নাড়ায় আনন্দ। বাগানে একটা আগাছা তুলতেও প্রাণে বাজে আনন্দর। কোনদিন অন্যের ক্ষতি করবার কথা ভুলেও ভাবেনি ও।
নার্স বেন নানা গল্প করে। ওর কুকুর ম্যাক্সের কথা বলে। কালো রঙের ল্যাব্রাডার রিট্রিভার। বলে ওর গ্র্যান্ডফাদারের গল্প। আশি বছর বয়স। কিন্তু ভারী সুন্দর বাগান করে। ফুলের বাগান। কিচেন গার্ডেনে নানা সব্জি।
জানালা দিয়ে আনন্দ দেখে পতপত শব্দ তুলে মেড-ফ্লাইট উড়ে আসছে। লাল টকটকে রঙ। কাছেই হেলিকপ্টারদের ল্যান্ড করবার জায়গা। আনন্দ ভাবে আমেরিকায় কীভাবে মেড ফ্লাইট উড়ে এসে প্রাণ বাঁচায় মানুষদের। ভাবে নিজের দেশ বাংলাদেশের কথা। মানুষ এখানে সেখানে কীভাবে মরে পড়ে থাকে। অবহেলায়। অথচ জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে আনন্দ লাল রঙের জল ফড়িঙের মত দেখতে মেড ফ্লাইটগুলো উড়ছে। জীবন বাঁচাতে।
(৯)
আজ ভোর চারটায় উঠেছে আনন্দ। লেকের উপর সূর্যোদয় দেখবে বলে। প্রথমে অল্প লাল হ’ল আকাশ। তারপর ছড়িয়ে পড়ল রঙ সারা আকাশ জুড়ে। কাগজে জলরঙ করতে নিলে যেভাবে রঙ ছড়িয়ে পড়ে ঠিক সেভাবে। আনন্দ জানালার কাছে গিয়ে বসে। ধীরে ধীরে ভোর হয়। তারপর সকাল। আজ ৮ই অক্টোবর। আনন্দর প্রিয় বন্ধু চুনির জন্মদিন। রূপে গুণে অনন্যা এক মেয়ে চুনি। যেমন ভালো গান গায়, তেমন ভালো নাচ করে। অসাধারণ রান্না করে ও। বানায় জলভরা মিষ্টি। জন্মদিনে হসপিটাল থেকে চুনিকে ফোন করে আনন্দ। নানা কথা বলে ওরা। বলে মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের কথা। বলে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার কথা। চুনি ওর দরাজ গলায় আবৃত্তি করে-
‘আমার মনের হিজেলের শাখা থেকে,
আমার একান্ত আপন পাখিকে-
আমি চিরকালের মত আকাশের করে দিলাম।’
(বুদ্ধদেব গুহ)
গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে আনন্দর চুনির আবৃত্তি শুনে। আকাশের দিকে তাকায় আনন্দ। ওর চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। মুক্তির চোখের জল।বুক ভেঙে যায়। তবু আনন্দ ওর একান্ত আপন পাখিকে চিরদিনের জন্য আকাশে উড়িয়ে দেয়।
(১০)
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে আনন্দ দেখে ওর মাথার কাছে একজন সীটার বসে আছে। আনন্দ পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছিল বলে ওকে এখন চব্বিশ ঘন্টা পাহারা দিয়ে রাখছে ডাক্তার, নার্স। একজন সীটার ওর সাথে সবসময় থাকে। রাতে ঘুমালেও ওকে জেগে পাহারা দেয় একজন। প্রথমদিকে খুব অস্বস্তি লাগলেও এখন অভ্যাস হয়ে গেছে আনন্দর। মনে হয় ও বুঝি বিরল প্রজাতির কোন পাখি। বার্ড ওয়াচারস ক্লাব খুলেছে বুঝি ওরা। পাহারা দিচ্ছে ওকে বাজপাখির মত। মনে পড়ে জন্মের পর আনন্দও কীভাবে ওর দুই মেয়ে এলা আর খেলাকে পাহারা দিত। মাঝরাতে চমকে চমকে উঠে দেখত বাচ্চারা নিশ্বাস নিচ্ছে কীনা। মূল্যবান জীবনকে পাহারা দিয়ে রাখতে হয়। অমূল্য জীবনকে পাহারা দিয়েই রাখতে হয়। ভালোবাসা দিয়ে।
প্রতিদিন ভোরের দিকে নার্স এসে আনন্দর পেটে একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে যায়। পেটের নরম মাংসে বেশ ব্যথা লাগে। আসলে আনন্দর বাম হাতে ব্লাড ক্লট হয়ে গেছে। আল্ট্রাসাউন্ডে ধরা পড়েছে। হাতটা ফুলে গেছে। বেগুনি হয়ে গেছে অর্ধেক হাত।
বেলা বাড়ে। নার্স এসে তাড়া দেয়। “দাঁত ব্রাশ করেছ? শাওয়ার নিয়েছ?” ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে আনন্দর। মা এভাবেই তাড়া দিত। একবার তো সময়মত স্নান করতে যায় নি বলে মা বাথরুমের দরজায় তালা দিয়ে দিয়েছিল! স্নান করতে যেতে হবে দুপুরে ভাত খেতে যাওয়ার আগে। কত যে অনাসৃষ্টি!
আনন্দ নার্সকে জিজ্ঞাসা করে,‘আমি কি একা একা শাওয়ার নিতে পারব?’ নার্স বলে,‘হ্যাঁ, পারবে। চেষ্টা কর। ধীরে ধীরে তো আবার নিজের সব কাজ নিজেকেই করতে হবে। আমি শ্যাম্পু, সাবান, লোশন সব রেখে দিয়েছি বাথরুমে।’ আনন্দ শাওয়ার স্টলের সীটে বসে অনেকক্ষণ ধরে স্নান করে। প্রায় সাতদিন পর। ঈষদুষ্ণ জল ওর শরীর বেয়ে নামে। শ্যাম্পু, সাবান মেখে মনে হয় যেন নবজন্ম হচ্ছে ওর। লোশন মেখে, চুল আঁচড়ে যখন নার্সের সামনে দাঁড়ায়, নার্স বলে ওঠে, ‘Wow! You look like a human again!’ আনন্দও খুব খুশি হয় নিজে নিজে নিজের যত্ন নিতে পেরে।
এদিকে আনন্দর খুব গলায় ব্যথা। ইসোফেগাসে ব্যথা। বুকে ব্যাথা। কানের ভিতর দিয়ে যেন সমুদ্রের বাতাস বয়ে যাচ্ছে। ডাক্তার বললেন, ‘হ্যাঁ এমন বেশ কিছুদিন চলবে। You were intubated.’ আনন্দ প্রথমে কথাটা ভালো বুঝতেই পারল না। ভাব্ল বুঝি বলছে, ‘You were incubated.’ আনন্দকে ওরা হলুদ মুরগীর ছানার মত ফুটিয়েছে? জীবন দিয়েছে? আনন্দর তুলতুলে নরম পালক…টুকটুক করে দানা খেয়ে চলেছে…ঘুরে ঘুরে…ঘুরে ঘুরে…
(১১)
এবার লেক মনোনার উপরের এই স্বর্গীয় ঘর ছেড়ে আনন্দকে যেতে হবে সাইক ওয়ার্ডে(psychiatric ward)। যেহেতু আনন্দের জামা কেটে ওকে ওরা বের করেছিল, তাই নিজস্ব কোন জামা কাপড় নেই আনন্দর। ও জেনারেল ওয়ার্ডের হসপিটাল গাউন পরেই হুইল চেয়ারে চেপে রওয়ানা দিল সাইক ওয়ার্ডের দিকে। অবশ্য সাইক ওয়ার্ডে পৌঁছেই এই গাউন বদলে সাইক ওয়ার্ডের বিশেষভাবে বানানো গাউন পড়তে হল। জেনারেল ওয়ার্ডের গাউনে ফিতা আছে। সাইক ওয়ার্ডে সুইসাইড প্রিভেনশনের জন্য কোন রকম স্ট্রিং, জুতার ফিতা, গলার মালা, ফোনের কর্ড, ব্যাগের হ্যান্ডেল, স্কার্ফ কিছুই কিছুই এলাউড না। ফ্লস ব্যবহার করতে চাইলে ফ্রন্ট ডেস্ক থেকে মেপে খানিকটা ফ্লস দেয় ওরা। ব্যবহার করবার পর তা আবার টিস্যুতে মুড়ে ফ্রন্ট ডেস্কে ফেরত দিয়ে আসতে হয়। বাথরুমে কোন দরজা নেই। একটা প্লাস্টিকের শক্তমত শীট ঝুলছে। চব্বিশ ঘন্টা কিছুক্ষণ পরপর ঘরে এসে চেক করে যায় নার্স। ঘরের দরজা লক করা যায় না। প্স্মার্ট ফোন ব্যবহার করবার জন্য নিজের কাছে রাখা যায় না পেশেন্টদের প্রাইভেসির কথা চিন্তা করে। যদি ছবি তুলে নেয় কেউ। মেন্টাল হেলথ পেশেন্টদের নিয়ে অনেক স্টিগমা সমাজে। আনন্দের মনে পড়ে ‘One Flew Over the Cuckoo's Nest’ বইটার কথা।
তবে ফোন যে একেবারে ব্যবহার করতে দেয় না এমন নয়। সকাল আটটা আর বিকাল চারটায় ১০ মিনিটের জন্য ফ্রন্ট ডেস্কে গিয়ে ওদের কাছে জমা রাখা ফোন ব্যবহার করা যায়। আনন্দর মনে হয় স্মার্ট ফোনে চব্বিশ ঘন্টা চোখ রাখা পুরো মানবসমাজের জন্য যদি এই নিয়ম কার্যকরী করা যেত!
তবে সুখের বিষয় এই যে সাইক ওয়ার্ডে অন্যান্য ওয়ার্ডের মত সারাদিন হসপিটাল গাউন পরে থাকতে হয় না। মন ভালো রাখবার জন্যই কীনা জানি না পেশেন্টরা নিজেদের ঝলমলে জামাকাপড়ই পরে ঘুরে বেড়ায় করিডোর দিয়ে। দেখলেই বিষন্নভাব কিছুটা কেটে যায়। কিন্তু আনন্দের তো নিজের কোন জামাকাপড়ও নেই। নার্স জুলিয়া আনন্দকে নিয়ে যায় একটা ঘরে। সেখানে ডোনেটেড অনেক জামা কাপড় আছে। আনন্দকে কিছু জামা কাপড় দেয় ও। একটা ছাই রঙের টি-শার্টের বুকে অনেক তারা আঁকা। আর একটা চাঁদ। লেখা আছে Believe in the moon and stars. বড় প্রিয় হয়ে গেল এই টি-শার্টটা আনন্দের।
(১২)
আনন্দের অনুমতি নিয়ে হাসপাতালে চ্যাপেল সার্ভিসের রেভারেন্ড ব্রাউন এলেন আনন্দের সাথে দেখা করতে। অবশ্য কখন ঈশ্বর, পরমপিতা, যীশুর কথা এসে পড়বে সেই ভয়ে সিঁটকে থাকল আনন্দ। না, সেসব কোন কথা উঠল না। আনন্দকে অবশ্য নার্স ম্যাগি আগেই বলেছিল এ নিয়ে চিন্তিত না হতে। আসলে ক্লাশ সেভেন থেকে স্বঘোষিত নাস্তিক আনন্দ। কোনরকম ধর্ম ও ধর্মপ্রচারের জায়গা নেই ওর জীবনে। ওর বাচ্চারাও তেমনই হয়েছে। ছেলেবেলায় বাচ্চারা অবশ্য বলত গ্রীক মিথলজি ওদের ধর্ম। দিনরাত গ্রীক মিথলজি পড়ত তখন ওরা।
রেভারেন্ড ব্রাউন জিজ্ঞাসা করলেন মৃত্যু থেকে ফিরে এসে কার কথা মনে পড়ছে খুব আনন্দের। আনন্দ বলে চলল, ‘এতদিন ডাক্তার, নার্সদের কথা খুব বেশি করে মনে পড়েনি আমার। কিন্তু মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে খুব মনে হচ্ছে আই সি ইউ-র ডাক্তার, নার্সদের কথা। কী অসীম নিষ্ঠায় তারা যুদ্ধ করেছে মৃত্যুর সাথে। এক একটা মুহুর্ত জয় করে নিয়েছে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে। মনে পড়ছে ওদের অগাধ জ্ঞান আর অসামান্য অভিজ্ঞতার কথা। শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসছে আমার।
আর মনে পড়ছে আমার এক্স-হাসবেন্ড সূর্য-র কথা। কীভাবে সে আমার জীবন বাঁচিয়েছে। ওর মুখে একটা দ্যুতি দেখেছি আমি। মানুষকে বাঁচানোর দ্যুতি।’
রেভারেন্ড ব্রাউন চুপ করে এতক্ষণ শুনছিলেন। এবার শুধু বলে উঠলেন, ‘This is powerful.’
তারপর রেভারেন্ড ব্রাউন নানা ব্রিদিং এক্সসারসাইজ শেখালেন আনন্দকে। শেখালেন প্রাণায়াম।
(১৩)
সাইক ওয়ার্ডের লিভিং রুমের নাম ওরা দিয়েছে ‘ডে রুম’। আলোয় ঝলমল করছে ঘর। মন খারাপ করে নিজের ঘরে বসে থাকলে নার্স সবসময় বলে ‘ডে রুমে’ যেতে। ‘ডে রুমে’ অন্যান্য পেশেন্টরা বসে নিজেদের মধ্যে গল্প করে। একসাথে টিভিতে কোন শো দেখে, মুভি দেখে। গল্পের বই, ম্যাগাজিন রাখা আছে। স্ক্র্যাবল, দাবা খেলবার, অরিগামি বানানোর ব্যাবস্থা আছে। ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাডিসনের ছাত্র-ছাত্রীরা ভলান্টিয়ার হিসেবে আসে বিকালবেলা সাইক ওয়ার্ডে। ‘ডে রুমে’ নানাকিছু খেলে ওরা পেশেন্টদের সাথে। আনন্দ দাবা খেলে প্রতিদিন একেকজনের সাথে। প্রতিবারই ও জেতে। কিন্তু শেষবার হেরে যায় একজন বয়স্ক ভলান্টিয়ারের কাছে।
একসাথে ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার খায় পেশেন্টরা ‘ডে রুমে’ বসে। এক হাসিখুশি জায়গা এই ‘ডে রুম’।
আনন্দ দেখে একজন পেশেন্ট ‘ডে রুমে’র টেবিলে একটা পাঁচশ পিসের জিগস পাজল শেষ করে বসে আছে। ‘Days to remember-autumn memories.’ প্রায় বেগুনি রঙের নীল আকাশ। সন্ধ্যায় প্রথম দেখতে পাওয়া চাঁদের দিকে ক্যানাডিয়ান গীজেরা উড়ে যাচ্ছে। লগ হোম, পাথরে গাঁথা তার চিমনি। ধোঁয়া উঠছে। সামনে একটা লাল পিক-আপ ট্রাক পার্ক করা। লেক সাইড বার থেকে জানালার হলুদ কাঁচের মাঝ দিয়ে সামনের লেকের জলে কমলা রঙের আলো আছড়ে পড়ছে। সাদা বার্চ গাছ। উইপিং উইলো।
ছোট ছোট ফিশিং বোট। দু’জন মাছ ধরছে। লেকের ডকে মনিবের গা ঘেঁষে বসে আছে গোল্ডেন রিট্রিভার কুকুর।
(১৪)
হাসপাতালে আনন্দের রুমের নাম্বার B6/550. রুমের একদিকের দেওয়াল জুড়ে সারি সারি জানালা। আজ বেশ ঝকঝকে রোদ উঠেছে। মুঠো মুঠো কাঁচের মত রোদ মেঝেতে আছড়ে পড়ছে। অনেক সময় রাস্তায় গাড়ির এক্সিডেন্ট দেখে আনন্দ। দেখে গাড়ির সামনের কাঁচ ছিন্নভিন্ন হয়ে হাইওয়ের উপর পড়ে আছে। এই কাঁচ একটু আলাদা মত। ভারী, মোটা। ফিনফিনে, পাতলা কাঁচের গ্লাসের মত নয়। সেই কাঁচ রোদ আনন্দের চোখের সামনে ছড়িয়ে পড়ে আছে।
ঘরে ঢুকলেন ডঃ প্যাট্রিসিয়া। উতসাহ দিলেন জার্নাল লেখা শুরু করতে। নিজের কথা লিখতে পারাটাও একটা থেরাপি। আরো বললেন ‘journaling is something you do for yourself.’ বলে কি? সারাজীবনই আনন্দ হচ্ছে ‘overture performing arts center.’ অন্যকে যদি না দেখাতেই পারে, তবে আর কিছু করা কেন? জীবনটা আনন্দের show and tell! ডঃ প্যাট্রিসিয়া বললেন, ‘Give it a try.’
ফলে প্যাপিরাসের উপর নল-খাগড়া দিয়ে আনন্দ লিখতে শুরু করল।
নেপালী নার্স কেতকী বলল তোমার ভালো পেন আছে? বলে ও নিয়ে এল পেন। হাসপাতালের সাধারণ বলপেনই। কিন্তু পেনটা একটু ইজি ফ্লোয়িং। ছেলেবেলার ফাউন্টেন পেনের মত বেশ সুন্দর লেখে। মনে পড়ে বাবার পাইলট পেনটা আনন্দ পেয়েছিল।
জার্নাল লিখতে শুরু করেছে জেনে খুব উত্তেজিত হয়ে উঠলেন ডঃ প্যাট্রিসিয়া।
‘Let me see. Let me see. Is it in English?’
‘No. In my language-Bengali.’
(১৫)
সাইক ওয়ার্ডে পেশেন্টদের মন ভালো করবার জন্য অনেককিছু করা হয়। গ্রুপ থেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি, ছবি আঁকা, এক্সারসাইজ… বেশির ভাগ পেশেন্টই এখানে নিজেকে ভালোবাসতে ভুলে যায়। তাই আজকের অকুপেশনাল থেরাপি ক্লাশে নিজেকে আর একটু বেশি ভালোবাসবার জন্য প্রশ্ন ছিল,‘তুমি নিজের কোন জিনিষটা সবচেয়ে বেশি ভালোবাস?’ জিনি বলল,‘আমি ভালোবাসি আমার চোখ। আমার চোখগুলো সবুজ রঙের। বেশি দেখা যায় না সবুজ রঙের চোখ।’ ডাক্তারকে অনুরোধ করে আজ বাড়ি চলে যাচ্ছে জিনি। থেকে থেকে চোখ জলে ভরে যাচ্ছে ওর। ‘আমার মেয়ের কথা মনে হচ্ছে খুব। ওকে জড়িয়ে ধরতে চাই। দুই বছর বয়স ওর। আমার নিজের বিছানার চাদরের গন্ধ শুঁকতে চাই। খুব কঠিন। কোন একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া বড় কঠিন। এখন চলে গেলে আমার চিকিৎসার ক্ষতি হবে। কিন্তু আমি তো পারছি না আর। জীবনে এতসব কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়!’ আনন্দকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদল জিনি। ‘তোমার মেয়ে আসবে তোমাকে নিতে?’ ‘না না, আমি চাই না ও দেখুক আমি সাইক ওয়ার্ডে আছি।’
হ্যাঁ, ভীষণ স্টিগমা সাইক ওয়ার্ড নিয়ে, মেন্টাল হেলথ কন্ডিশন নিয়ে। সাধারণ জ্বর হলে আমরা পরিচিত সবাইকে বলতে পারি। কিন্তু লুকিয়ে রাখি, এমনি করেই আমরা সবাই লুকিয়ে রাখি সব ধরণের মানসিক অস্থিরতা। লুকিয়ে রাখি স্কিৎসোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিসঅর্ডার। অজানা কারণেই লজ্জায় মরে যাই।
(১৬)
আজকের অকুপেশনাল থেরাপি ক্লাশে একটা ছোট্ট কাঠের বার্ড-হাউস রং করল আনন্দ। বাড়িটার দেওয়াল হলুদ রঙের। ছাদ নীল রঙের। পায়ের কাছে সবুজ ঘাস। তাতে ফুটে আছে লাল, হলুদ, সাদা রঙের ছোট ছোট ফুল। এত সুন্দর হয়েছে বার্ড-হাউসটা যে আনন্দ চোখ ফেরাতে পারে না। অন্যান্য পেশেন্টরাও এসে দেখে যায় আনন্দর বার্ড-হাউস। খেলাকে দেয় আনন্দ বার্ড-হাউসটা।
পোস্টার বানানোর ক্লাশও হয় আজ। আনন্দ আঁকে একটা নীল ফুল। ঘন নীল রঙ। দু’টো সবুজ পাতা। নীচে লেখা ‘Flowers can be blue too.’ খেলা খুব খুশি হয় পোস্টারটার কথা শুনে।
যখন কিছু আঁকে, যখন কিছু লেখে আনন্দর মাথায় যেন জোনাকি জ্বলে। সারাদিনে ওইটুকু সময়ই যেন আলো জ্বলার। ওইটুকু সময়ই বেঁচে থাকার।
(১৭)
আজকের গ্রুপ থেরাপি ক্লাশে নিজেদের জীবনের কথা শেয়ার করতে বলল সিন্ডি।
পেশেন্ট জন বলে চলে, ‘আমি আমার হাই-স্কুলের ভ্যালেডিকটরিয়ান ছিলাম। 4.0 GPA. এলজেবরা আর ফিজিক্স আমার প্রিয় সাবজেক্ট।’ মুগ্ধ হয়ে দেখে জন-কে আনন্দ।
‘এখন হসপিটালেই কাজ করি আমি।’ আনন্দ ভাবে হয়ত ডাক্তার বা নার্স জন। তাদেরও তো মেন্টাল হেলথে সাহায্য দরকার হতে পারে।
কিন্তু না। জন বলে, ‘আমি হসপিটালের গারবেজ ট্রাক চালাই।’
‘কলেজে যাও নি তুমি?’, জিজ্ঞাসা করে আনন্দ।
‘নাহ!’
আনন্দ দেখে জনের চোখের কোণে এক কণা বালির মত জল চিকচিক করছে।
(১৮)
আনন্দের পাশের ঘরে থাকে স্কিৎসোফ্রেনিয়ার পেশেন্ট লুকাস। করিডোরে হাঁটে ও। নিজের মনে হাসে। নিজের মনে কথা বলে। এমনভাবে মাথা নেড়ে নেড়ে চলে যে মনে হয় পাশেই কেউ বুঝি আছে। মাঝে মাঝেই হো হো করে হেসে ওঠে। লুকাসকে দেখতে বাড়ি থেকে কেউ আসে না। একা, একদম একা যুদ্ধ করছে ও। আর যুদ্ধ তো শুধু অসুখের সাথেই নয়, যুদ্ধ পরিবারের সাথে, যুদ্ধ সমাজের সাথেও।
স্কিৎসোফ্রেনিয়া ভয়ংকর অসুখ। হ্যালুসিনেশন হয়। অন্যজন যা শুনতে না পায়, তা শুনতে পায় পেশেন্ট। শোনে পেশেন্টকে আত্মহত্যা করতে বলছে কোন কন্ঠস্বর। কোনদিন সারে না স্কিৎসোফ্রেনিয়া।
লুকাসকে দেখে মন খুব খারাপ হয়ে যায় আনন্দর। মনে হয় গিয়ে ওর হাতটা একটু ধরে। গুনগুন করে গায়-
'আজ তারায় তারায় জ্বলুক বাতি
আমার আঁধার সরিয়ে দাও...
বন্ধ ঘরের দুয়ার ভেঙে
আলোয় আমায় ভরিয়ে দাও...
আমার জীবন-মরুর অভিশাপে
একটু সবুজ ছড়িয়ে দাও
তারায় তারায় জ্বলুক বাতি
আমার আঁধার সরিয়ে দাও।'
(সুর ও কন্ঠ- হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
কথা- গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার)
(১৯)
মানুষ পাগল তো হয়ই। প্রেমে, পাপে, পুণ্যে…আর আনন্দ বেদনায়। জীবনের মানে খুঁজে পায় না ও। সাইক ওয়ার্ডের করিডোর ধরে পায়চারি করে। উত্তর থেকে দক্ষিণে। আবার দক্ষিণ থেকে উত্তরে। দেয়ালে বিরাট বড় একটা চাঁদ আঁকা। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চারদিক। একটা লাল রঙের শিয়াল মুখ উঁচু করে ডাকছে চাঁদের দিকে তাকিয়ে। পিছনে বাঁশঝাড়। নানা পেন্টিং ঝুলছে সাইক ওয়ার্ডের দেয়াল জুড়ে। জীবনের ছবি। আনন্দও ফিরে আসতে চায় জীবনে। কিন্তু ওর নদীর উপরের সাঁকোটা ভাঙা।
এদিকে ইনটিউবেশনের জন্য অসম্ভব ব্যথা আনন্দের গলায়, কানে। ব্রিদিং টিউব দিয়ে পাঁচদিন ছিল ও ভেন্টিলিটারে। ব্যথা যদি একটু কমে, তার জন্য সারাদিন কফ-ড্রপ খেয়ে চলেছে ও। আর থেকে থেকেই চা আর কফির বদলে গরম চিকেন ব্রথ। পুষ্টিও হবে আর গলার ব্যথাতেও একটু আরাম হবে।
সেদিন ব্যথার জন্য ও গলা আর মাথায় একটা টি-শার্ট স্কার্ফের মত জড়িয়ে করিডোর ধরে হাঁটছিল। সাথে সাথে দু’জন নার্স ওকে ওর ঘরে ডেকে নেয়। জিজ্ঞাসা করে ধর্মীয় কারণে হিজাব পড়েছে কিনা ও। আর যদি সাধারণ স্কার্ফ হয় তবে তা মানা। পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার হাতিয়ার হতে পারে স্কার্ফ। সতর্কতার অন্ত নেই সাইক ওয়ার্ডে। আনন্দ ওদের আশ্বস্ত করে বলে এটা কেবল একটা টি-শার্ট ।
আনন্দ দেখে আরেকজন পেশেন্ট প্রিসলি সবসময় মাথায় একটা টুপি পড়ে থাকে। ওর দেখাদেখি আনন্দও বাড়ি থেকে স্কার্ফের বদলে টুপি আনিয়ে নিল। সত্যিই টুপি পড়ে অনেক আরাম হল। নিজেকে সদ্যজাত শিশুর মত মনে হল। মনে পড়ে যখন এলা আর খেলা জন্মের পর হসপিটালে ছিল, ওদের শরীরে হয়ত তখনও জামা পরানো হয় নি, কিন্তু মাথায় টুপি দিয়ে দিয়েছিল নার্স।
আনন্দরও তো নতুন জীবন, নতুন জন্ম। উলের টুপির পমপম ঝুলছে সেই জীবন থেকে। নরম, তুলতুলে।
(২০)
হাসপাতালের জানালা থেকে আনন্দ হঠাৎ তাকিয়ে দেখে পাশের হাইরাইজ বিল্ডিং-এর ছাদ থেকে একটা লোক মই বেয়ে নামছে। ঝাঁপ দেবে নাকি লোকটা? আনন্দ ভয়ে শিউরে ওঠে। ঠিক দেখছে তো ও? নাকি এ আই সি ইউতে দেখা হ্যালুসিনেশনের মত কিছু? আই সি ইউ-র আলো দেখে আনন্দর মনে হচ্ছিল বুঝি তা ম্যাকডোনাল্ডের সাইন। হাসপাতালের চারদিক ম্যাকডোনাল্ডের মারচ্যান্ডাইজ দিয়ে বুঝি সাজিয়েছে। চুনি দেখতে এসেছিল আনন্দকে সেদিন। আনন্দ ওকে ম্যাকডোনাল্ডের কথা বলল। না তেমন কিছুই নাকি নেই চারপাশে। সবই আনন্দর হ্যালুসিনেশন। নিজ চোখে দেখা এত সত্যি কিছু সত্যি নয়? অবিশ্বাস্য! আর একবার দেখল ঘরময় হাজার হাজার জলফড়িং উড়ে বেড়াচ্ছে। তাদের কাচের পাখা। কী অপূর্ব যে দেখতে। দেখল কল থেকে যে জল পড়ছে তা যেন জলপ্রপাত। কী যে সুন্দর। নিজের চোখকে যখন বিশ্বাস করা যায় না তখন বড় অসহায় লাগে।
আনন্দ ফ্রন্ট ডেস্কের দিকে গেল। যা দেখছে তা যাচাই করতে। নিজের চোখের সামনে একটা লোক ঝাঁপিয়ে পড়বে তা তো আর হতে দেওয়া যায় না! আনন্দ নিজে মৃত্যুর পথে হেঁটেছিল, কিন্তু অন্য কাউকে মৃত্যুর পথ থেকে ছিনিয়ে আনতে ও আজও বদ্ধপরিকর।
নার্স এল ওর সাথে ফ্রন্ট ডেস্ক থেকে। না, এ আনন্দের হ্যালুসিনেশন নয়। সত্যিই একটা লোক হাই রাইজ বিল্ডিং-এর উপর। নার্স আশ্বস্ত করল আনন্দকে। ও কন্সট্রাকশনের কাজ করছে।
তবে কি আনন্দ সুস্থ হতে শুরু করেছে? যাকিছু সবাই দেখে তাই দেখছে ও আজকাল? পাতলা পর্দার ওপাড় থেকে ভেসে আসা ছবি নয় আর? নয় যা কিছু ছোঁয়া যায় না সেইসব কাঁচের পাখার জলফড়িং? কিংবা এ শুধু নয় সবদিক ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া জলপ্রপাতের শব্দ?
(২১)
আজ ভোরবেলা ঘুম ভেঙেই এলা, খেলা আর ক্রোকাসের কথা মনে পড়ল আনন্দর। কতদিন দেখেনি ওদের। বিশেষতঃ ক্রোকাসকে। কুকুরকে তো আর হাসপাতালে আসতে দেবে না। অথচ ওই বুঝি সবচেয়ে বেশি অপেক্ষা করছে আনন্দর জন্য। অবুঝ প্রাণী। কিছু তো বোঝাতে পারে না। আনন্দর চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। গলার কাছটা ব্যথা করে। মনে পড়ে জিনির কথা। ও কেমন চিকিৎসা শেষ না করেই মেয়ের কাছে ফিরে গিয়েছিল। প্রিয় মানুষদের ছেড়ে হাসপাতালে দিনের পর দিন কাটানো কঠিন, বড় বেশি কঠিন।
এমন সময় নার্স এসে বলে যায় তৈরী হয়ে নিতে গ্রুপ ক্লাশের জন্য। ক্লাশে ছয়টা খোপ কাটা কাগজ দেয়। খোপগুলোতে ছবি এঁকে বা লিখে বোঝাতে হবে কখন ও ভালো আছে। ফিজিক্যাল ঘরে আনন্দ আঁকে ওয়েট লিফট করছে এমন এক বডিবিল্ডারের ছবি। নিচে লেখে ফিজিক্যাল ওয়েট লিফটিং ই একসময় মানসিক ওয়েট লিফটিং-এ সাহায্য করে। স্পিরিচুয়ালের খোপে আনন্দ আঁকে জুঁইফুলের ছবি। যেদিন ও আবার জুঁইফুলের গন্ধ শুঁকতে পাবে সেদিন বুঝবে ও ভালো হয়ে গেছে। ইমোশনালের খোপে আনন্দ আঁকে দু’টো মানুষের ছবি। ও আর একজনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যেদিন আবার অন্য কাউকে জড়িয়ে ধরতে পারবে, জানবে সেদিন ও সুস্থ হয়ে গেছে। বই পড়তে পারে না আনন্দ। তাই মেন্টাল খোপে ও লিখল যেদিন আবার বই পড়তে পারবে, সেদিন বুঝবে ভালো হয়ে গেছে ও। একসময় অনেক রান্না করত আনন্দ। আজকাল আর কিছুই পারে না। তাই সোশ্যাল খোপে ও লিখল যেদিন আবার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের জন্য অনেক কিছু রান্না করতে পারবে, জানবে ভালো হয়ে গেছে ও। আর আছে একটা খোপ ‘আদার’ বলে। আনন্দ সেখানে একটা খাতা আঁকল, আঁকল একটা কলম। লিখল, ‘আবার যেদিন আমি গল্প লিখতে পারব।’
(২২)
হসপিটালের বেডে বসে আনন্দ ফিজেট টয় নিয়ে খেলছিল। লোকে বলে এই টয়গুলো এংসাইটি, রাগ, হতাশা, দুঃশ্চিন্তা দূর করতে সাহায্য করে। আনন্দর ফিজেট টয়টা বেগুনি রঙের প্লাস্টিকের, চারকোণা, চব্বিশটা করে বল আছে তাতে। বলগুলো একদিক দিয়ে টিপে দিলে অন্যদিকে ফুলে ওঠে। আনন্দ এই খেলনাকেই বানালো প্রাণের কুকুর ক্রোকাসের সাথে ফেচ খেলার বল। একদিক দিয়ে বল টিপে দেয়, অন্যদিকে বল ফুলে ওঠে। যেন ছোট্ট ক্রোকাস ক্যাচ ধরছে বল। হসপিটালে বসে ক্রোকাসের সাথে খেলবার এই মেক বিলিভ ফেচ খেলা ছাড়া আর উপায় কি? খুব মিস করছে ক্রোকাসকে আনন্দ। হসপিটালে বসে প্রাণীদের মিস করা আর মানুষদের মিস করা এক কথা নয়। হসপিটালে বসে প্রাণীদের দেখতে পাওয়া যায় না। স্মার্ট ফোনে ‘ক্রোকাস, ক্রোকাস’ বলে ডাকলে ও ফিরে তাকায়। এদিক ওদিক ইতিউঁতি চায়। কিন্তু ছবিতে ফোকাস করতে পারে না। বুঝতে পারে না যে আনন্দ ওকে ডাকছে। ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে না গায়ে।
তবে সুখের বিষয় হচ্ছে এই যে ছোট্ট ক্রোকাস চলেছে খেলা আর সূর্যের সাথে সূর্য-গ্রহণ দেখতে ম্যাডিসন থেকে কর্পাস ক্রিস্টি। শুনেই তো হসপিটালের অন্যান্য পেশেন্টরা হেসেই অস্থির। বাইশ ঘন্টা গাড়িতে চেপে যাবে ও। আনন্দ তো চিন্তায় অস্থির। কিন্তু না, বেশ ভালোই গেছে ড্রাইভ করে ক্রোকাস। পথে হাইক করেছে, রেস্টুরেন্টের বাইরে বসে খেয়েছে, স্যান্ড ডিউন দেখেছে, ট্রেইলে হেঁটেছে। না, ওর সূর্য-গ্রহণ দেখবার জন্য কোন ছোট্ট সানগ্লাস লাগেনি।
সূর্য অবশ্য আনন্দকে একটা সানগ্লাস দিয়ে গিয়েছিল যদি হসপিটালের কোন জানালা দিয়ে সূর্য-গ্রহণ দেখতে পায়। কিন্তু না, সকাল থেকেই ম্যাডিসনে অন্ধকার আকাশ, বৃষ্টি। ‘রিং অফ ফায়ার’ দেখবার সৌভাগ্য হয় নি আনন্দর। নিজের আলোহীন অন্ধকারেই সারাদিন ডুবে থেকেছে ও। আর ক্রোকাস আলোর মাঝে।
(২৩)
আনন্দের মনে পড়ে নিউইয়র্ক টাইমসে পড়া একটা আর্টিকেলের কথা। মহিলার বাইপোলার ডিসঅর্ডার। জীবনটা যুদ্ধের মাঝ দিয়ে গেছে। এ জীবন কেমন জীবন? মরতে মরতে বেঁচে থাকা। সেই বেঁচে থাকবারও কোন নিশ্চয়তা নেই। যে কোন সময়ই শেফালী ফুলের মত ঝরে পড়তে পারে ফুল। মহিলাটি অনেক যুদ্ধ করে ৬০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। তারপর লেখে 'This June, I’m turning 60. I’m having a small party to celebrate my ingathering of selves. My old self was first to R.S.V.P.' আনন্দের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। আনন্দও কি বাঁচবে ৬০ বছর পর্যন্ত?
প্রতিদিন সকালে উঠেই ওর মরে যেতে ইচ্ছে করে। বাইপোলার ডিসঅর্ডারের অভিশাপ। হামাগুঁড়ি দিয়ে দিয়ে কোনমতে জীবনের ওপর প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছানো। পৃথিবীর আলো, হাসি, গান কিছুই মুগ্ধ করে না আনন্দকে।
তবু আনন্দ অপেক্ষা করে ওর ৬০ বছরের জন্মদিনের জন্য। কনফেটি উড়ছে, স্ট্রিমারস, মোমবাতির নরম আলো, দোতালা সাদা কেক-উপরে পীচ দেওয়া, ঘরভর্তি লোক, ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ’ গান হচ্ছে, বাচ্চাদের হাসাহাসি-ছুটোছুটি-জীবনের ছবি।
মরতে মরতেও বড় লোভ হয় আনন্দের বেঁচে থাকবার জন্য। সে জীবনে যেখানে বকুলফুলের গন্ধ।
(২৪)
সাইক ওয়ার্ডের পেশেন্টরা কোন না কোনভাবে হারিয়ে যেতে চেয়েছিল জীবন থেকে, তবু এখন ওদের জীবনের হাইলাইট হচ্ছে তিনটা কথা। ঘরের দরজায় নার্সের ধাক্কিয়ে বলা, ‘Breakfast is here.’ ‘Lunch is here’ কিংবা ‘Dinner is here.’ দিনের পর দিন দুধ চিরিও খেয়ে থেকেছে আনন্দ। তবু এই কথাগুলো শুনলে চনমন করে ওঠে ওর মন। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে ‘ডে-রুমে’ যায় ও। অন্য পেশেন্টদের সাথে একসাথে বসে গল্প করতে করতে খায়। মন বেশি খারাপ থাকলে আর কথা বলতে ইচ্ছা করে না কারো সাথে। তখন একা একা নিজের ঘরে বসে খাবার খায় আনন্দ।
বেশিদিন হাসপাতালে থাকলে হাসপাতালের খাবার মেনু মুখস্থ হয়ে যায়। আনন্দরও মুখস্থ হয়ে গেছে ছোট ছোট করে লেখা চার পৃষ্ঠার মেনু। মেনু না দেখে নিজে থেকেই ও অর্ডার করে খাবার। সবসময় তিনটা ডিমের বিরাট এক ওমলেট করে হাসপাতালে। ব্রেকফাস্টে তার মাঝে আনন্দ যোগ করে টমেটো, পিঁয়াজ, বেল পেপার, পালং শাক। মেড টু অর্ডার। সাথে নেয় এনসিওর থেরাপিওটিক নিউট্রিশন। আনন্দের ভালো লাগে ক্লিয়ার আপেল। মিক্সড বেরি ফ্লেভার আর চকলেট ফ্লেভারও ভালো লাগে ওর। নার্স ওকে বলেছে প্রতিটি মিলের সাথে এনসিওর যোগ করতে। এনসিওর কমপ্লিট মিল। আনন্দর শরীর একদম ভেঙে পড়েছে। আর যা কিছুই খাক না কেন, সাথে এনসিওর থাকলে অনেকটা শরীর ভালো হবে। সত্যিই তাই। আনন্দ যেন ওর শক্তি ফিরে পাচ্ছে। নিজে নিজে হাঁটতে পারে। বেশ কয়েক পা যেতে পারে। দু কাপ করে চিকেন ব্রথও অর্ডার করে আনন্দ। পুষ্টির জন্য, গলায় ব্রিদিং টিউব বসানোর জন্য যে ব্যথা হয়েছে তার জন্য।
দুপুরে বা রাতে মেনু না দেখে মন থেকেই অর্ডার করতে পারে আনন্দ-‘shrimp scampi-linguine served with shrimp, garlic,oregano and olive oil finished in a butter sauce.’ ‘steamed broccoli’, ‘mashed potato’, ‘fruit leather’, ‘cheesecake’.
কিংবা
‘Chicken pot pie-peas, carrots and diced chicken in a cream sauce, and topped with puff pastry’, ‘sweet thai stir fry’, ‘soup of the day’. ‘apple pie’.
মাঝে মাঝে অর্ডার করতে ভুলে যায় আনন্দ। তখন ডাইনিং হলের ডাটাবেস থেকেই আগে যা অর্ডার করেছিল কোনদিন তা থেকে ওর জন্য খাবার পাঠায় ডাইনিং হল – মিটলোফ, ম্যাশড পটেটো, ম্যাশড পটেটোর মাঝে অল্প গর্ত করে চিকেন গ্রেভি। টোস্ট, এপেলসস, দুধ, কফি।
খুবই পুষ্টিকর খাবার দাবার পেশেন্টদের জন্য। গল্প করতে করতে খায় পেশেন্টরা। জীবনের গল্প। যে জীবন ওদের ছিল কিংবা যে জীবন আর কোনদিনই ওদের হবে না।
(২৫)
এতদিনে আনন্দর ঠোঁট অল্প অল্প নড়ছে। থিরথির করে কাঁপছে। বিড়বিড় করে ও বলে চলেছে-
“I went out to the hazel wood,
Because a fire was in my head”
(William Butler Yeats)
সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের রঙের পার্থক্য ওর চোখের উপর থেকে মিলিয়ে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে দূর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে আই সি ইউ, ভেন্টিলেটর, ইনটিউবেশন, ব্রিদিং টিউবস, টেম্পরারি পেসমেকার…মিলিয়ে যাচ্ছে ডাক্তার, নার্সদের গলার স্বর-‘Any thought of hurting yourself? Hearing voices? Seeing things?’
(শেষ)
কল্যাণী রমা
"As for me, I am a watercolor.
I wash off."
— Anne Sexton
্প্রকাশিত বই-
আমার ঘরোয়া গল্প ; হাতের পাতায় গল্পগুলো – ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা; রাত বৃষ্টি বুনোহাঁস – অ্যান সেক্সটন, সিলভিয়া প্লাথ, মেরি অলিভারের কবিতা; মরণ হ’তে জাগি – হেনরিক ইবসেনের নাটক; রেশমগুটি; জলরঙ; দমবন্ধ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন