আমার মেয়ে

আকাশদীয়া চক্রবর্তী-কে 

ছোট পাখি

---

আজ আমার ছোট্ট মেয়ে এক ছোট পাখি হ’য়ে ডানা মেলে উড়ে যাবে। আকাশ নীল হয়েছে। ওর ডানায় উড়বার শক্তি হয়েছে।
আমার কাদা আর খড়কুটো দিয়ে বানানো নড়বড়ে বাসা যে কোন সময়েই গাছের ডাল ভেঙে মাটিতে পড়ে যেতে পারে। আমার বাসা আর নিরাপদ নয়। আমার হাত অশক্ত। আর আমি আমার ছোট পাখিকে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারব না।
গাছটায় যদিও চেরিফুলের মত অনেক ছোট ছোট হালকা গোলাপি ফুল ফুটে আছে। ছোটপাখি এক পা, দু’ পা ক’রে বাসা ছেড়ে ফুলের উপর এসে বসল। আমি আমার ভাঙা বাসা থেকে তারপর তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম, ছোটপাখি আকাশে উড়ে গেল।
আকাশে রঙধনু উঠেছে। ঝড় নেই। বৃষ্টি শেষ হয়েছে। মাটি থেকে আনন্দের মত, ড্যান্ডিলাইয়নের সাদা সাদা তুলোর মত ফুল আকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছে...
বহু বছরের রাতজাগা চোখ থেকে জল মুছে আমি শুধু কোনমতে বললাম, ছোটপাখি, পুরো ডানা মেলে উড়ে যেও। আকাশটা অনেক বড়।

আহ্লাদ
---
ছেলেবেলায় আহ্লাদে গলে পড়ত আমার মেয়ে। ঘাড় একপাশে কাত ক'রে শরীর এলিয়ে। মেয়েরা যখন ছোট থাকে, পৃথিবী ওদের স্পর্শ করে না। শ্যাওলা জমে না সেখানে, শুধু ফুল।
মেয়েদের বড়বেলায় ওরা শ্যাওলার সবুজে মুগ্ধ হয়। শ্যাওলা নরম ভেবে তার উপর হাঁটতে যায়। পা পিছলে পড়ে নিজের পৃথিবী হারায়।
ওগো মেয়ে, উজ্জল আলোয়, পাতার সবুজে, আহ্লাদে বাঁচ। শ্যাওলার সবুজে নয়।

সুর
---
আমি ভাবতাম সুর ছাড়া জীবন মৃত। তাই আমার ছোট পাঁচ বছরের মেয়েকে ভায়োলিন, পিয়ানো, ফ্লুট, কয়্যার, আর ভারত নাট্যম নাচের ক্লাশে ভর্তি ক'রে দিলাম। যদি কোনভাবে কুস্তি করেও একটা কিছু শিখতে পারে! কিন্তু ওর ওভারডোজ হ'য়ে গেল। ছয় বছরের মধ্যে ওভারচার আর্টস সেন্টারের নাচের অনুষ্ঠান থেকে পালানোর পায়তারা করল। টমবয় মত ছিল ও। কানে পাশা পড়লে ব্যথা পায়। মাথায় ফুল দিতে চায় না। ফোর্থ গ্রেডে ফ্লুট বাদ। ধুকে ধুকে ভায়োলিন, পিয়ানো কোনমতে হাইস্কুল পর্যন্ত চলল।
কথায় বলে সংগীত গুরুমুখী বিদ্যা। আমার মেয়ের সংগীত শিক্ষা কতদূর হ'ল, কী ওর লাভ হ'ল জানিনা; তবে ওর মিউজিক টিচাররা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড হ'য়ে গেল। সারা জীবনের জন্য বন্ধু। আশেপাশের আলু, পিঁয়াজ বেচা মানুষের পাশে এই সুরপাগল মানুষগুলো আমায় মুগ্ধ করত - জীবনের গ্রেস নোটস।
শেষ পর্যন্ত গলায় সুর তোলা, কিংবা কোন বাদ্যযন্ত্রে সুর তোলা আমার মেয়ের হ'য় নি। মনে হ'য় শুধু স্টাফনোটস পড়তে শিখেছে, 'দু:খরাতের সাথী' হ'য়ে তোতাপাখির মত।
তবু ভাবি অন্যকে শোনানোর জন্য নয়, যখন চারদিক অন্ধকার হ'য়ে আসবে ও যেন একটা খোলা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের জন্য গলা ছেড়ে গান করতে পারে। সে সুর শুনে বৃষ্টির ফোঁটা ওর চোখের পাপড়িতে পড়বে।

প্যাঁচ
---
খুব ছেলেবেলায় আমার ছোট মেয়ে গভীর মনোযোগের সাথে, ঘন্টার পর ঘন্টা বসে বসে ছোট ছোট হাতে শিশির ছিপির প্যাঁচ খুলত। ছোট হাতে সবসময় ও পেরে উঠত না। তবু চেষ্টা ও কম করে নি।
কিশোরীবেলায়, তারুণ্যে, যৌবনে, কিংবা বার্ধক্যেও মেয়েরা সবশক্তি দিয়ে জীবনের জটিলতার জট ছাড়াতে চেষ্টা ক'রে। জীবনের জট বটের ঝুড়ির মত সোজা নেমে নীরব, শীতল মাটি স্পর্শ ক'রে না। তা ধোঁয়ার মেঘে নীহারিকা হ'য়ে আকাশ ছেয়ে থাকে। হিলিয়াম গ্যাস আর ধুলোর আড়াল পেরিয়ে নীহারিকার আলো কয়েকশ' আলোকবর্ষ পেরিয়ে হৃদয়ে পৌঁছায় না।

উড়ে যাওয়া
---
আমার মেয়ে যখন ছোট ছিল, ও মনে হ'য় হাঁটত না, উড়ত। মেয়েরা যখন ছোট থাকে, ওরা উড়তে পারে। একটা পুরো আকাশ ওদের থাকে। সে আকাশে এত তারা জ্বলে যে ওদের তারা হ'তে ইচ্ছে ক'রে। সে আকাশ থেকে এত বৃষ্টি ঝরে যে মেয়েদের জল হ'তে ইচ্ছে ক'রে। সে আকাশের সূর্যের দিকে তাকিয়ে ওরা আলো হ'তে চায়।
জীবনের বাঁকে বাঁকে সূর্যের আলো নিভে যায়। চোখের জলে বৃষ্টির জল ধুয়ে যায়। তারা নিভে গেলে তারার ধ্বংসাবশেষ পাথরের বুকে আছড়ে পড়ে।
মেয়েদের জীবনে সেই আকাশটুকু থাকুক যেখানে ওরা পুরোটা জীবন ধ'রে উড়তে পারে। ডানা মেলে।

(আমার মেয়েকে কলেজে ছেড়ে আসবার পথে লেখা )
জুন ১, ২০২১
ম্যাডিসন, উইস্কনসিন।


মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ


কল্যাণী রমা-র জন্ম ঢাকায়। ছেলেবেলা কেটেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ভারতের খড়গপুর আই আই টি থেকে ইলেকট্রনিক্স এ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল কমুনিকেশন ইঞ্জিনীয়ারিং-এ বি টেক করেছেন । এখন আমেরিকার উইস্কনসিনে থাকেন। অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট সিনিয়র ইঞ্জিনীয়ার হিসাবে কাজ করছেন ম্যাডিসনে।
প্রকাশিত বইঃ
আমার ঘরোয়া গল্প;
হাতের পাতায় গল্পগুলো ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা;
রাত বৃষ্টি বুনোহাঁস অ্যান সেক্সটন, সিলভিয়া প্লাথ, মেরি অলিভারের কবিতা;
মরণ হতে জাগি হেনরিক ইবসেনের নাটক;
রেশমগুটি;
জলরঙ;
দমবন্ধ।